বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ১০, ২০২৪

আপনাকে আপনি চেনা,সেই তো বটে উপাসনা

প্রকাশ :

মো: নাইম হাসান রিদয়

লালন সাঁইজির কত কঠিনেরে কত সহজে বলে গেছেন। আরশিনগরের পড়শি দর্শনের আকুলতার পথ ধরেই জীবন জিজ্ঞাসা শুরু। সময়ে সময়ে সেটি প্রমাণ দিয়েছেন লালন সাঁইজি। সাইঁজির অমর বাণী গান কিংবা অন্যান্য বিষয়ে মায়াজালে পাগল করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন ওপারে। কিন্তু সময়ের অতলে সবাই কী হারিয়ে যায়?

শূন্যতায়,শোকার্ত,স্মৃতিতে,প্রেরণার বাতিঘর হয়ে টিকে থাকেন কিছু জন। বেচে থাকে নীরবে অনুকরণে মার্যাদার ভাস্কর -আর তার প্রস্থানের বেদনার সুর বাজবে বহু অন্দরে।

ঠিক সেই অন্তরের সুর ধরে টিকে আছেন বাউল মরমী সাধক লালন সাইঁজি। কি অদ্ভুত এই মায়াজাল তাদের ভক্তকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেউরিয়া নামক স্থানে লালন সাইঁজির আখড়া অবস্হিত। আখড়ার প্রবেশ পথের দু’পাশে রয়েছে বিভিন্ন দোকান। দোকান গুলো তে রয়েছে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা, কুলফি ভালাই,বাঁশি, একতারা, নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি, লালন সাঁইজির অমর বাণী দিয়ে আকানো বিভিন্ন রকমের কারুকাজ,কাঠের তৈরি নানা জিনিসপত্র।

কয়েকটি দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে লালনের ভাস্কর্য, লালন সাঁইজীর ছবি দিয়ে গেন্জী,ফতুয়া আর ছোটদের খেলনা। সাড়ে ১৪ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই লালনের আখড়া। আখড়াই রয়েছে লালন একাডেমি ভবন ও লালন সাঁইজি কমপ্লেক্স, লালন পাঠাগার, বাউল অডিটোরিয়াম, লালন রিসোর্স সেন্টার ও লালন জাদুঘর।

ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছেন মরমী সাধক বাউল লালন শাহ্। তার সমাধির পাশে রয়েছে জননী মা মতিজান ফকিরানী এবং বাহিরে জন্মদাতা পিতা মাওলানা মলম শাহ্ এর সমাধি। মাজার কমপ্লেক্সে লালন শাহ্ সহ আরও সে সময়ের লালন সাঁইজির সাথে থাকা মোট ৩২ জনের সমাধি। মাজার তদারকি করে থাকেন খাদেম ফকির আলী শাহ্। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ, গায়ে দুধের মতো সাদা রঙের পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি এবং মাথায় সাদা পাগড়ি। নিরলস খেদমত করে চলেছেন,নেই যেন তার কোনো ক্লান্তি। কথিত আছে, আজ থেকে ২৪৫ বচর আগে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে মরমি সাধক ফকির লালন শাহ জন্মগ্রহণ করেন।

যদিও এ নিয়ে রয়েছে নানা মত আর নানা বিভেদ। কথা হয়, আখড়ার দায়িত্বে থাকা খাদেম ফকির আলী শাহসহ বেশ ক’জন লালন অনুসারীর সাথে, লালন শাহ্ এর বয়স তখন আনুমানিক ১৬ কিংবা ১৭ বছর, তীর্থ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। তীর্থকালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যান। এক মুসলিম নারী যার নাম মতিজান ফকিরানী।এই নারী নদীতে পানি আনতে গিয়ে দেখেন কলাগাছের ভেলার ওপর শুয়ে আছে বসন্ত আক্রান্ত এক কিশোর।

দ্রুত তার স্বামী মাওলানা মলম শাহকে ডেকে দেখান মতিজান। মলম শাহ দেখেন, কিশোরের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে,হৃদ কম্পন আর্তনাদে এখনো প্রাণের স্পন্দন আছে। মুসলিম এই দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না। তারা এই কিশোর লালন সাঁইজি কে নিজেদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নেন। লালন অনুসারীরা আরও জানান, সুস্থ হওয়ার পর লালন গুরু সিরাজ শাহের সান্নিধ্য পান এবং তার কাছেই থেকেই বছরের সুদীর্ঘ জীবনে ভজন সাধন এর মাধ্যমে খ্যাতি লাভ করে উঠেন লালন সাঁইজি নামে। এভাবে তার চলতে থাকে গান-বন্দনা, সাধন-ভজন।

কিন্তু বাড়ি তার মনকে বার বার ডাকতে থাকে। সেই ডাকেই একদিন তিনি ফিরে যান তার নিজের গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু ‘মুসলিম পরিবারে খেয়ে লালনের জাত গেছে’ এই বলে তার স্বজনরা তাকে ফিরিয়ে দেন। তাইতো লালন বলেন- জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।

আসবার কালে কি জাত ছিলে! এসে তুমি কি জাত নিলে।

নিজের বাড়ি থেকেও বের হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন লালন। নিজের পরিবার স্বজন থাকতেও একাকিত্বের জীবন নিয়ে চলতে শুরু কর নতুন পথ। তিনি আবারও ফিরে যান তার সেই পালক বাবা-মায়ের কাছেই। মরমী সাধক লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না,ছিলেন স্বশিক্ষিত। মুসলিম মহাগ্রন্থ আল কোরআন তার সম্পূর্ণ মুখস্ত ছিল, যোগ করেন ফকির আলী শাহ।

আর ওজানান,মাওলানা মলম শাহ প্রতিদিন নিয়ম করে ফজরের নামাজের পর কোরআন তিলাওয়াত করতেন। একদিন লালন শাহ্ কোরআন তিলাওয়াত শুনে বললেন, ‘কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ হচ্ছে না। ’ তবে লালনের গানগুলো বিচার করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, লালন সচেতন ভাবেই জাত-ধর্ম গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। তাইতো লালন বলে গিয়েছেন, “কেউ মালা কেউ তসবিহ গলে তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে” আসা কিংবা যাওয়ার কালে জাতের চিহ্ন রয় কারে।১৮৮৯ সালের ৫ মে শিলাইদহের জমিদার হাউসের ( যা এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি ) বোটে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে হাজির হন লালন সাঁইজি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা জোতীন্দ্রনাথ তাকে নিজ হাতে ধরে বসিয়ে দেন একটা চেয়ারে এবং পেন্সিল দিয়ে তৈরি করেন লালনের একটি স্কেচ ছবি। লালন তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ,জীবনের শেষ সময়ে নুয়ে পড়া অবস্হা। সেখান থেকেই পাওয়া যায় লালনের স্কেচ।তারপর সেটি সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে সেটি ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। লালন সাঁইজীর সঙ্গে নোবেল প্রাপ্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কখনও সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা এখনো নিশ্চিত না।

তবে এটা নিশ্চিত যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের প্রতি বেশ মোহিত ছিলেন। এই বাউল সম্রাট মরমী সাধক লালন সাঁইজির গানের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি হবে।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর (পহেলা কার্তিক, ১২৯৭ বঙ্গাব্দ) শুক্রবার ভোরে ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

spot_imgspot_img

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

কোটিপতি হলেই কি সম্পদের সারচার্জ দিতে হবে?

মোঃ আতিকুল্লাহ সরকার,বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস সম্পদের সারচার্জ হল একটি অতিরিক্ত কর যা বিত্তবান বা উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি সম্পন্ন...

দেশে প্রথম উপস্থাপনা নিয়ে রিয়েলিটি শো’র চ্যাম্পিয়ন ড্যাফোডিলের জয়া

মমতাজ হারবাল প্রোডাক্টস এর সার্বিক সহযোগিতায় এনটিভি আয়োজিত ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা ‘আলো ছড়াবে উপস্থাপনায়’। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের...

পাবিপ্রবিতে সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে ছাত্রীর আত্মহত্যা

পাবিপ্রবি প্রতিনিধি: পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাস দিয়ে আত্নহত্যা করেছে। ঐ...

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথমবার শেখ ফরিদ পলক; ফাস্ট লুকেই বাজিমাত

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রকাশ পেয়েছে ‘জয় বাংলা ধ্বনি’ সিনেমার তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনেতা শেখ ফরিদ পলকের ফার্স্ট লুক। শুক্রবার...

পাবিপ্রবির বিআরটিসি বাস ভাঙচুর, আহত ১

দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াতের ডাকা চলা টানা ৪৮ ঘন্টার হরতালে ভাঙচুর করা হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি)...

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

কোটিপতি হলেই কি সম্পদের সারচার্জ দিতে হবে?

মোঃ আতিকুল্লাহ সরকার,বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস সম্পদের সারচার্জ হল একটি...

হেমন্তের মায়াময় ক্যাম্পাস

বেরোবিপ্রতিনিধি, আল আমিনকুয়াশার চাদরে ডাকা স্নিগ্ধ ভোর, সবুজ ঘাসের...

সেরা প্রশিক্ষক পুরষ্কার পেলেন বাংলাদেশের ইউসুফ ইফতি

দক্ষিন এশিয়ার সেরা প্রশিক্ষক হিসেবে পুরস্কার পেলেন প্রশিক্ষন খাতের...

Medical representative attrition rate rises in Bangladesh

The attrition rate of medical representatives rises crucially in...