রুহুল আমিন হৃদয়:
পাহাড়, ঝর্ণা এই শব্দগুলো শুনলে প্রথমেই মনে আসে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল গুলার কথা। কিন্তু শুধু এই শব্দগুলোতেই পরিপূর্ণ নয় বঙ্গ ললনার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের সৌন্দর্য্যমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রাম (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান)।কারণ এই পার্বত্য অঞ্চল সম্পূর্ণ হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও বিচিত্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সমন্বয়ে।পাশাপাশি পাহাড়, লেক, ঝর্ণা ইত্যাদির মেলবন্ধন যেন এখানকার বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালি জাতির অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক।
দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের এই পাহাড়গুলোর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রায় সাড়ে ১৮ লক্ষ (২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী বাঙ্গালী ৫০.০৬% এবং অবাঙ্গালী অর্থাৎ চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা ইত্যাদি মিলিয়ে ৪৯.৯৪%) মানুষের বসবাস অনন্য এক চিত্র রূপায়ন করে যা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে জীবনান্দের রূপসী বাংলা হিসেবে।
১৫৫০ সালে ‘চাকোমাস’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি মোঘল আমলে সুবাহ বাংলার অধীনে শাসিত হয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ রা এর নামকরণ করে চিটাগাং হিল ট্র্যাক্স বা পার্বত্য চট্টগ্রাম হিসেবে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের আওতাভুক্ত এই অঞ্চল চট্টগ্রাম জেলার অংশ হিসাবে বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের একটি জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যা ১৯৮০ দশকের শুরুতে বিভক্ত হয় তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান হিসেবে।
ব্যস্তময় দিন,মাস বছর শেষে জীবনানন্দ একটুকরো সুখ খুঁজে পেয়েছিল নাটোরের বনলতা সেনের চোখে। একই ভাবে সারাবছর ব্যস্ততায় ক্লান্ত থাকার পর যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমনে আসেন তাহলে হঠাৎ করেই আপনার চোখে পরবে একটি সুউচ্চ পাহাড় থেকে দূর দূরান্তের ছোট ছোট টিলা, ঝড়ণা, লেকের সৌন্দর্য, পাহাড়ি ঘরবাড়ি এবং পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠা পাহাড়ি শহর। মনে হবে হাত বাড়ালেই যেন মেঘ ছোঁয়া যাবে। স্বভাবতই আপনার চোখ ও মনে এমন এক প্রশান্তির উদ্ভব হবে এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনমনেই কখন শুকরিয়া আদায় করে ফেলবেন তা বলাবাহুল্য। তখন হয়ত মনে হবে বাকিটা জীবন নাহয় এখানেই কাটিয়ে দেই। পার্বত্য অঞ্চলের ঠিক এমন সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হয়েই প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভীড় জমায় খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের পর্যটনকেন্দ্র গুলোতে। যাদের মধ্যে বিদেশের পর্যটকদের সংখ্যাটাও যথেষ্ট বিবেচনার যোগ্য।
বর্তমান সময়ে আকর্ষনীয় পর্যটনগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন এর পরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান।
কত কবি ও লেখক তাদের লেখায় এই স্বর্গকে তুলে ধরেছে তার হিসেব নেই।
“গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ
আমার মন ভুলাই রে……”
এই গানটি কেই বা না শুনেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্পাকৃতির আকাঁবাকা পাহাড়ি রাস্তাও সহজে সাধারণ মানুষ বা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম। আর পাহাড়ি ঝড়ণায় যাওয়ার সময় এডভেঞ্চার প্রিয়দের মন আনন্দে ভরে উঠে।
পার্বত্য অঞ্চলগুলাতে সমান ভাবে মিশে আছে বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালি মানুষের জীবনধারা। যদিও স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ডে পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, তবুও পাহাড়ে জীবনধারনের জন্য সবাই মিলে মিশে বাস করছে।
প্রত্যন্ত বেশ কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই তিন জেলা বাংলাদেশ সরকারের যথেষ্ট চেষ্টার কারণে অল্প অল্প করে শিক্ষা ও যাতায়াত ব্যবস্থায় উন্নত হচ্ছে। যদিও এখনো অনেক পরিবর্তন বাকি। যথেষ্ট সুযোগ সুবিধার অভাবে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে এই অঞ্চল গুলো। অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো দু একজন শিক্ষকের হাতেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।তাছাড়া,যাতায়াত ব্যবস্থার ভালো সুযোগের অভাবে ভালো স্কুলে পড়তেও সমর্থ হচ্ছেনা পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা। চিকিৎসা ব্যবস্থায় ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতি আনয়নের লক্ষ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কোটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন বাংলাদেশ সরকার। যাতে করে,পশ্চাৎপদীয় উপজাতি ও অউপজাতি পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দারা যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা পাওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
বর্তমান সময়ে কাঠ ব্যবসায়ীদের কুনজর পড়েছে পাহাড়ি বনভূমির উপর। ফলে উজার হচ্ছে বন এবং প্রকৃতির উপর পড়ছে বিরুপ প্রভাব। পার্বত্য অঞ্চলের সৌন্দর্য্য দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড় কেটে নগড়ায়ন এবং পর্যটন শিল্পের অব্যবস্থাপনার কারনে এই স্নিগ্ধ ও মায়াময়ী পাহাড়ের পরিবেশ, ইকোসিস্টেম ও সৌন্দর্য্য নষ্ট হচ্ছে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে এখনি। সরকারকে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে পাহাড় কাটা, বন উজার দমন করতে হবে। সুষ্ঠ পর্যটন শিল্পের বিকাশ করতে হবে। সন্ত্রাস দমনের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বপরি যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং বাঙ্গালী অবাঙ্গালীদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পাহাড়ের উন্নয়ন সম্ভব।
লেখকঃ রুহুল আমিন হৃদয়, শিক্ষার্থী,
লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।