অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম (শিমু) হত্যায় তাঁর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম জড়িত, তিনি এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। খন্দকার শাখাওয়াত ও তাঁর বন্ধু এস এম ওয়াই আবদুল্লাহ ফরহাদকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, কথা-কাটাকাটির জের ধরে গত শনিবার গভীর রাতে রাইমা ইসলামকে গলাটিপে হত্যা করেন স্বামী। পরদিন সকালে বস্তাবন্দী লাশ নিয়ে ঢাকার নানা জায়গায় ঘুরে রাতে কেরানীগঞ্জের হজরতপুর এলাকার আলীপুর সেতুর নিচে ফেলে আসেন। পরে বাসায় ফিরে রাইমার বোনকে সঙ্গে নিয়ে কলাবাগান থানায় স্ত্রী নিখোঁজের ডায়েরি করেন।
গত সোমবার সকালে কেরানীগঞ্জ থেকে রাইমা ইসলামের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে পরিচয় শনাক্ত না হলেও নিহতের আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় তথ্যভান্ডারে মিলিয়ে পুলিশ জানতে পারে, তিনি রাইমা ইসলাম।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত রাইমা ইসলাম স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম ও দুই সন্তানের সঙ্গে কলাবাগানের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৯৯৮ সালে বরেণ্য পরিচালক কাজী হায়াতের বর্তমান চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। ২০০৪ সাল থেকে তিনি সিনেমায় অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তবে টিভি নাটকে অভিনয় করতেন। সবশেষ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে চাকরি নিয়েছিলেন। স্বামী শাখাওয়াত অনেক দিন ধরে বেকার। দুই সন্তানের একজন ও লেভেলে পড়ে, অন্যজনের বয়স সাত বছর।বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার দুপুরে রাইমার কলাবাগানের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা ও বড় মেয়ে বসে আছেন। এর মধ্যেই ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সর্দার সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, রাইমা হত্যার ঘটনায় তাঁর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম ও তাঁর বন্ধু আবদুল্লাহ ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের দোষ স্বীকার করেছেন। যে গাড়ি ব্যবহার করে রাইমার লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়েছে, সে গাড়িও জব্দ করা হয়েছে। অন্যান্য আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, দাম্পত্য কলহের জের ধরে রাইমা ইসলাম খুন হয়েছেন।
এরপর বিকেলে রাইমার বড় ভাই হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে কেরানীগঞ্জ থানায় খন্দকার শাখাওয়াত ও তাঁর বন্ধুকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত।
এদিকে বিকেলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে রাইমার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হত্যাকাণ্ডে ভগ্নিপতির সম্পৃক্ততার কথা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রাইমার বোন ফাতেমা নিশা। কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় বিকেলে ভগ্নিপতির মুখোমুখি করার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসেন। স্বজনদের বলেন, শাখাওয়াত হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এ বিষয়ে শাখাওয়াত বা তাঁর বন্ধু ফরহাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্লাস্টিকের সুতার সূত্র ধরে আসামি শনাক্ত
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এক টুকরা প্লাস্টিকের সুতার সূত্র ধরে এই হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছেন তাঁরা। তাঁরা জানান, ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে সোমবার সকাল ১০টার দিকে কেরানীগঞ্জের আলীপুর সেতুর কাছ থেকে তাঁরা লাশ উদ্ধার করেন। মৃতদেহের পরনে ছিল আটপৌরে ঢিলেঢালা পোশাক, তবে হাত ও পায়ের নখে নেইল পলিশ দেখা যায়। মুখাবয়ব দেখে তাঁরা ধারণা করেন, মৃতদেহটি কোনো সংস্কৃতিকর্মীর হতে পারে। এরপর আঙুলের ছাপ মিলিয়ে জানতে পারেন, নারীর নাম রাইমা ইসলাম শিমু। তিনি নিখোঁজ বলে কলাবাগান থানায় জিডি করেছেন তাঁর স্বামী।
পরিচয় পেয়েই সোমবার সন্ধ্যার দিকে রাইমাদের কলাবাগানের বাসায় যায় পুলিশ। তাঁর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম সে সময় বাসায়ই ছিলেন। পুলিশের প্রশ্নের জবাবে শাখাওয়াত বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রাইমা বলেছিলেন, তিনি মাওয়া যাচ্ছেন। স্বামীর এই বক্তব্যে খটকা লাগে পুলিশের। রাইমা আটপৌরে সালওয়ার-কামিজে ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে পরিপাটি হয়ে বাইরে যেতেন, বেড়াতে গেলে তাঁর এমন পোশাকে যাওয়ার কথা নয়।
এরপর পুলিশ তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়িটি দেখতে যায়। গাড়ির পেছনে থাকা সুতার বান্ডিল দেখে স্বামীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে সন্দেহ জোরালো হয় পুলিশের। রাইমাকে বস্তায় পুরে যে সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল, গাড়ির পেছনে পাওয়া যায় সেই একই সুতা। গাড়িটি সেদিনই ধোয়া হয়েছিল এবং গাড়ির ভেতরের দুর্গন্ধ দূর করতে ছিটানো হয়েছিল ব্লিচিং পাউডার।
এরপর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শাখাওয়াত হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন ধরে স্ত্রীর সঙ্গে শাখাওয়াতের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ১৫ জানুয়ারি বেশ রাতের দিকে আবারও ঝগড়া হয় দুজনের। তখন শাখাওয়াত রাগের মাথায় রাইমাকে প্রথমে একটা চড় মারেন, পরে গলা টিপে ধরেন। রাইমা মারা গেছেন বুঝতে পেরে তিনি তাঁর বাল্যবন্ধু আবদুল্লাহ ফরহাদকে খবর দেন। তারপর দুই বন্ধু মিলে রাইমাকে বস্তায় ঢুকিয়ে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে সেলাই করেন।
সকাল ১০-১১টার দিকে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীকে নাশতা আনতে পাঠিয়ে শাখাওয়াত ও ফরহাদ দুজন মিলে মৃতদেহ ধরাধরি করে গাড়িতে তোলেন। তার আগে সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। তাঁদের ইচ্ছা ছিল মিরপুর বা রূপনগরের দিকে ফাঁকা জায়গা দেখে রাইমার মৃতদেহ ফেলে দেবেন। লোকজন থাকায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে লাশ নিয়ে তাঁরা বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আবারও তাঁদের কলাবাগানের বাসায় ফেরেন। কিছুক্ষণ পর আবারও বের হন। এবার দুজনই তাঁদের মুঠোফোন বন্ধ করে নেন। মোহাম্মদপুরের বসিলা দিয়ে কেরানীগঞ্জের আলীপুর সেতুর কাছে মৃতদেহ ফেলে বাসায় ফিরে আসেন। ফোন চালু করতেই রাইমার পরিবারের লোকজন অনবরত তাঁদের ফোন করতে থাকেন। তাঁরা জানান, রাইমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে রাতে শাখাওয়াত রাইমার বোন ফাতেমা নিশাকে সঙ্গে করেই কলাবাগান থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে যান।
রাইমার ছোট ভাই শহিদুল ইসলাম খোকন জানান, শাখাওয়াত একসময় মোটর পার্টসের ব্যবসা করতেন। সাত-আট বছর ধরে কিছু করেন না। কলাবাগানের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটি শাখাওয়াতদের পৈতৃক জমির ওপর তোলা। এই ভবনের বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট শাখাওয়াতের। ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে চলতেন তিনি।