ঘড়িতে ১১টা ছুঁইছুঁই। ক্লাসের শিক্ষার্থীরা টিচার্স লাউঞ্জের সামনে অপেক্ষমাণ। সবাই হাসিখুশি, কারো কোনো তাড়া নেই। সবার হাতে একটা-দুইটা বই। এই দৃশ্য পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের (সিএসই) সামনের। এরা সবাই ‘বই ঘর’ থেকে বই নিতে এসেছেন। এখানে সপ্তাহ দুয়েক পর পরই এই দৃশ্যের দেখা মেলে।
শুরুটা যেভাবে
বুয়েটের সিএসই প্রাক্তন শিক্ষার্থী সুবীর সাহা পাবিপ্রবির সিএসই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর দেখলেন এখানকার শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিষয়ের জ্ঞান ভালো থাকলেও পারিপার্শ্বিক জ্ঞান খুবই কম। সুবীর সাহা মনে করেন শিক্ষার্থীদের বইয়ের জ্ঞান যেমন প্রয়োজন বইয়ের বাহিরের জ্ঞানও তেমন প্রয়োজন। শিক্ষকতার তিন বছরের মাথায় সুবীর সাহা সিদ্ধান্ত নিলেন শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিবেন। শিক্ষার্থীদের বই পড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে পাঁচটি বই নিয়ে সিএসই বিভাগে গড়ে তুলেন ‘বই ঘর’।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সাহিত্য, চাকরি, কোডিং, আত্মোউন্নয়ন, বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ৫০০ এর অধিক বই এই লাইব্রেরিতে আছে।
একা হেঁটে চলা
শুরুতে ‘বই ঘর’ একটা ব্যাচের ৪০জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। প্রথম দিকে শিক্ষার্থীদের সাড়া তেমন একটা মেলেনি। শিক্ষার্থীদের বই নেয়ার জন্য বলা হলেও, শিক্ষার্থীরা বই নিচ্ছিল না। সুবীর সাহা এতে হতাশ হননি। কাজ চালিয়ে গেলেন। তিনি জানতেন, প্রথমেই শিক্ষার্থীরা আসবে না, শিক্ষার্থীরা বই পড়ার গুরুত্ব বুঝতে পারলে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করবে।
বাড়তে থাকে পাঠক সংখ্যা
২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে সুবীর সাহা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। অনেক শিক্ষার্থীই ‘বই ঘর’ এ আসতে শুরু করেছে। তারা নিয়মিত বই নিচ্ছে আবার সময় মতো বই ফেরত দিচ্ছে। ‘বই ঘর’ এ কী কী বই আছে তারা খোঁজ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেখে বই ঘরে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমে শুরু হলো প্রজেক্ট মুক্তিযুদ্ধ। এই প্রজেক্টের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা ৫০টি বই কেনা হলো। এভাবে এক এক করে চালু করা হলো প্রজেক্ট চাকরি, প্রজেক্ট উচ্চ শিক্ষা, প্রজেক্ট কোডিং, প্রজেক্ট সাহিত্য, প্রজেক্ট আত্ম উন্নয়ন। বর্তমানে সিএসই বিভাগের ১৬০জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২৫জন শিক্ষার্থীই বই ঘরের পাঠক।
৫ বছরে হারায়নি একটি বইও
বই ঘর বিষয়ে শিক্ষক সুবীর সাহার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা ‘বই ঘর’কে এত ভালোবাসে যে এই পাঁচ বছরে ওরা একটি বইও হারায়নি, একটা বইয়ের পাতা ছিঁড়েনি, একটা বই চুরিও হয়নি।
ভালোবাসার অন্য নাম বই ঘর
সুবীর সাহা বললেন, পাঁচ বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা বই ঘরকে আপন করে নিয়েছে। প্রথম দিকে বই কেনা আমার যে রকম তাড়া থাকত, এখন আর সেটা নেই। যারা গ্রাজুয়েশন শেষ করে, তারা যাওয়ার আগে ব্যাচের পক্ষ থেকে বই দিয়ে যায়। যেসব শিক্ষার্থীরা চাকরি পায় তারা প্রথম বেতনের টাকা থেকে ‘বই ঘর’ এ বই কিনে দেয়। আমাদের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাপান থেকে প্রোগ্রামিংয়ের তিন কেজি ওজনের একটা বই নিজে এনে এখানে দিয়েছেন।
বই ঘর থেকে ফলাফল আসছে
২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আনন্দ মিয়া বলেন, এখান থেকে আত্মউন্নয়ের বইগুলো নিয়ে পড়ছি। ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য এই বইগুলো বেশ কাজে দিচ্ছে। বই ঘর না থাকলে টাকা দিয়ে এই বইগুলো কেনা হতো না।
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অংকন সাহা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার আগে ক্লাসের বইয়ের বাইরে তেমন কোনো বই পড়া হতো না। এখানে এসে ‘বই ঘর’ থেকে বই নিতে শুরু করি। এখন নিয়মিতই বই পড়ছি এবং নিত্যনতুন অনেক বিষয় জানতে পারছি।
এই বিষয়ে সুবীর সাহা বলেন, একটা পরিবর্তনের আশা নিয়েই বই ঘরের যাত্রা শুরু। এখানে বিভিন্ন ধরনের বই আছে। শিক্ষার্থীরা চাকরিতে ভালো করছে, গ্রাজুয়েশন শেষ করেই এখন উচ্চ শিক্ষা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের এখানে উচ্চ শিক্ষার বই আছে। তারা জানতে পারছে কীভাবে উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে, কী থেকে কী করতে হবে।
পাশে ছিলেন সহকর্মীরা
বই ঘর এর শুরু থেকে বিভাগের কোনো শিক্ষক এখানে হস্তক্ষেপ করেননি। সুবীর সাহা পেয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা। সুবীর সাহার ভাষায়, বই ঘর শুরুর পর থেকে আমার সহকর্মীরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। এটার বিরোধিতা কেউ করেননি, বরং আমাকে কাজ করে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন।
সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রহিম বলছেন, বই ঘর শিক্ষার্থীদের একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের শিক্ষকবৃন্দ বই ঘরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। আমাদের পক্ষে যতটুকু সহযোগিতা করার প্রয়োজন আমরা ততটুকু সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
সংকটেও স্বপ্ন দেখা
বিগত পাঁচ বছরের পথচলায় ‘বই ঘর’ এর সবচেয়ে বড় সংকট ছিল জায়গার। বিভাগ থেকে সুবীর সাহাকে দেওয়া রুমই ‘বই ঘর’এর অফিস। সুবীর সাহার গবেষণা, একাডেমিক কাজ, লেখাপড়াও এখানে চালাতে হয়।
তবে বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে রুমের সংকট থাকার কারণে বই ঘরকে আলাদা রুম দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনটি নির্মাণ হয়ে গেলে বই ঘরকে আলাদা জায়গা দেওয়া হবে।
জায়গার সংকটের ভেতরেও সামনে বই ঘরের কার্যক্রম বিস্তৃত করার কথা জানান সুবীর সাহা। বই ঘর শিক্ষার্থীদের আলোকিত করে তুলবেন, আর শিক্ষার্থীরা এই আলো সমাজে ছড়িয়ে দিবেন বলে বিশ্বাস করেন সবাই।