একজন গ্রাহক ব্যাংক থেকে কত টাকা ঋণ ও ঋণসুবিধা নিতে পারবেন, তা নতুন করে নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি একটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ কত শতাংশ হবে, তা–ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। নতুন এই নীতিমালা চলতি বছরের মধ্যে কার্যকর করতে হবে।
নতুন এই নীতিমালার হিসাব হবে শুধু মূল ঋণের ওপর, সুদসহ নয়। পাশাপাশি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে নন ফান্ডেড ঋণসুবিধার সুযোগও। ফলে দেশের বড় ব্যাংকগুলোর ভালো গ্রাহকেরা চাপে পড়েছেন। কারণ, তাদের ঋণ চলতি বছরের মধ্যে কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। ঋণ কমিয়ে আনার জন্য ইতিমধ্যে এসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করছে ব্যাংকগুলো।বিজ্ঞাপন
তবে যেসব ব্যবসায়ীর ঋণ ও সুদ প্রায় সমান হয়ে সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বা বেশি হয়ে গেছে, তাঁরা সুবিধা পাবেন। কারণ, এখন হিসাব হবে শুধু মূল ঋণের ওপর। তাই ঋণ শোধ না করা ব্যবসায়ীরা তাতে সুবিধা পাবেন। আর ভালো গ্রাহকেরা পড়বেন বিপাকে। কারণ, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ঋণ স্থানান্তর করা যায় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালায় সুবিধা পাবেন বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা, আর চাপে পড়বেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। কারণ, বিদ্যুৎ খাতের নন ফান্ডেড ১০০ টাকার ঋণকে ২৫ টাকা হিসাবে ও পোশাক খাতের ১০০ টাকার ঋণকে ৫০ টাকা হিসাবে গণনা করা হবে। বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এ অবস্থায় এই নীতিমালা পরিবর্তন বা সময় বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে পারে ব্যাংকগুলো।বিজ্ঞাপন
পোশাক খাত থেকে বেশি আয় করে এমন শীর্ষ ছয় ব্যাংক হলো হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি), ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবি, ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।বিজ্ঞাপন
ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে ঋণ প্রদানের সীমা কোনোভাবেই ওই ব্যাংকের রক্ষিত মূলধনের ২৫ ভাগের বেশি হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নীতিমালা দেয়। সেখানে বলা হয়েছে, ঋণপত্র, গ্যারান্টিসহ বিভিন্ন নন ফান্ডেড ঋণ ও ফান্ডেড ঋণের (সরাসরি ঋণ) পরিমাণ সুদসহ কোনোভাবেই মূলধনের ৩৫ শতাংশের বেশি হবে না। তবে রপ্তানিমুখী খাতের জন্য এই সীমা হবে ৫০ শতাংশ। দুই ক্ষেত্রেই ফান্ডেড ঋণ (সুদ ছাড়া) হবে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ।
তবে গত রোববার জারি করা নীতিমালায় বলা হয়েছে, নন ফান্ডেড ও ফান্ডেড ঋণ (সুদ ছাড়া) মিলিয়ে একটি গ্রুপ কোনোভাবেই ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ পাবে না। এ ক্ষেত্রে ফান্ডেড ঋণ হবে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। তবে সব ধরনের নন ফান্ডেড ঋণে ১০০ টাকার দায়কে ৫০ টাকা ও বিদ্যুৎ খাতের ১০০ টাকার দায়কে ২৫ টাকা হিসাবে গণনা করতে হবে।
ফলে রপ্তানিমুখী খাতের ঋণের সীমা বেড়ে হবে ৩৫ শতাংশ ও বিদ্যুৎ খাতের সীমা বেড়ে হবে ৫৫ শতাংশ। এতে রপ্তানিমুখী খাতের ঋণের সীমা আগের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গেল। রপ্তানিমুখী খাতের ৯০ শতাংশ ঋণ পোশাক খাত–সংশ্লিষ্ট। আগে হিসাব হতো সুদসহ, এখন হিসাব হবে মূল ঋণ ও ঋণ সুবিধা।
দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ১২-১৫ জন গ্রাহকের ঋণে এই নির্দেশনার প্রভাব পড়বে। তাঁদের ঋণ কমাতে হবে। তবে এক বছর সময় আছে এই ঋণ কমানোর। এ সময়ে আমরা চেষ্টা করব, গ্রাহকেরাও আমাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করবেন বলে আশা করছি।’বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, ইউসিবির মোট মূলধন এখন প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নতুন নীতিমালার আওতায় ব্যাংকটি রপ্তানিমুখী খাতের একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ ও ঋণ সুবিধা নিতে পারবে। তবে ব্যাংকটির গ্রাহক ফোর এইচ, মাইক্রো ফাইবার, মণ্ডল ও পানাম গ্রুপের ঋণ এর চেয়ে বেশি। কারণ, আগের নিয়মে একজনকেই আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে পারত ব্যাংকটি।
ইসলামী ব্যাংকের মোট মূলধন এখন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। নতুন নিয়মে ব্যাংকটি একটি গ্রুপকে ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে পারবে না। তবে এর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ঋণ আছে এস আলম গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। তবে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘ব্যস্ততার কারণে আমরা এখনো যাচাই করে দেখতে পারিনি, কোনো গ্রাহকের ঋণ কমাতে হবে কি না। তবে সীমার বেশি ঋণ আমরা কোনো গ্রাহককে দিইনি।’
পূবালী ব্যাংকের মূলধন প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি এখন একজন গ্রাহককে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বেশি দিতে পারবে না। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পোশাক খাতের বড় গ্রুপগুলোতে আমাদের অর্থায়ন আছে। এ জন্য এই নীতিমালার প্রভাব অবশ্যই আমাদের ওপর পড়বে।
সাউথইস্ট ব্যাংকের মূলধন প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি কাউকে ঋণ ও ঋণসুবিধা দিতে
পারবে না। তবে ব্যাংকটির গ্রাহক দেশবন্ধু ও কেয়া গ্রুপের ঋণ এর চেয়ে বেশি। ব্যাংকটির এমডি এম কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’