বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সুপারিশ করা হয়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় গত ২৩ অগাস্ট কমিটির বৈঠকে এ শিল্প নগরী ‘আপাতত বন্ধ রাখার’ সুপারিশ করা হয়েছিল। এখনও তার বাস্তবায়ন না হওয়ায় বৃহস্পতিবারের বৈঠকে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছে কমিটি।
কমিটির সুপারিশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) চিঠি দিয়েছিল। চামড়া শিল্প নগরী ‘কেন বন্ধ করা হবে না’, তা বিসিকের কাছে জানতে চেয়েছিল সংসদীয় কমিটি।
তবে ওই চিঠির জবাব ‘সন্তোষজনক হয়নি’ বলে বৃহস্পতিবারের বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী জানান।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “কেন বন্ধ করা হবে না- এই প্রশ্নে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তারা ওই নোটিসের জবাব দিয়েছে। তারা কিছু পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। ওই জবাবটি আমাদের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।
“সেজন্য আমরা ট্যানারি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছি। পরিবেশ মন্ত্রী এই বিষয়ে শিল্পমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর ট্যানারি শিল্প বন্ধে পদক্ষেপ নেবে।”
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, “আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ইট কান্ট কন্টিনিউ। এখন যেভাবে আছে, তা চলতে দেওয়া যাবে না। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সলিড ওয়েস্ট । সেখানে এটা ট্রিটমেন্টের কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা নেই।”
এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সভাপতি বলেন, সাভারের প্রায় ১২৫টি ইউনিটের মধ্যে ২৪টি ইউনিট ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করেছে। তারা জানিয়েছে, তাদের ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটি আছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সেসব ইউনিট পরিদর্শন করবে জানিয়ে সাবের বলেন, “নিয়মের মধ্যে পড়লে সেগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর তার বিদ্যমান আইনের অধীনে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ট্যানারি শিল্প বন্ধ করবে।”
এখন সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়, অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটার। ক্রোমিয়াম শোধনের ব্যবস্থাও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে নেই।
সংসদীয় কমিটি বলছে, দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য সেখানে পরিবেশে মিশছে। এই হিসাবে গত তিন বছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে গেছে।
এ কারণে গত অগাস্টে সাভারের ট্যানারি বন্ধের সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। এরপর গত সেপ্টেম্বরে ‘চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সুপারিশ তৈরি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণের লক্ষ্যে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের বৈঠকে এই শিল্পের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
ঢাকার হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের অনীহা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের এপ্রিলে আদালতের নির্দেশে তাদেরকে সেখানে যেতে বাধ্য হতে হয়। অথচ কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) এবং অন্যান্য সব কাজ এখনও শেষ হয়নি।
এ অবস্থায় কিছু ট্যানারি পরিবেশ ছাড়পত্র পেলেও এখন পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়নে সময় নেওয়া হচ্ছে। এতে রপ্তানিকারকরা কমপ্লায়েন্স মানতে গিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন বলে ট্যানারিমালিকদের ভাষ্য।
চামড়া শিল্পে আন্তর্জাতিক মানসম্মত পরিবেশে নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার কাজে হাত দেয় বিসিক। তবে দীর্ঘদিনেও তা স্থানান্তর না হওয়ায় উচ্চ আদালত হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেওয়ার পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে কারখানাগুলো একযোগে স্থানান্তরিত হয়।
সেখানে ১৫৫টি ট্যানারিকে জমি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করে দেওয়ার কথা বিসিকের। তারা এ জন্য একটি চীনা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয় ২০১২ সালে। তবে তারা যথাসময়ে সিইটিপি পুরো চালু করতে পারেনি। আবার এই সিইটিপির সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সাবেক হোসেন বলেন, “তারা সাত-আট বছর ধরে যেখানে ট্যানারি শিল্প চালু করেছে, অথচ পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদনটি পর্যন্ত করেনি এবং তারা নিরবচ্ছিন্ন দূষণ করেই যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “নদী দূষণের দায়ে ২০২০ সালে চামড়াশিল্প নগরীকে চার কোটি ৬২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। তারা এর বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। আমরা বলেছি, ওই টাকা জরিমানা হিসেবে তাদের দিতে হবে।”
সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিবেশ দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমপ্লায়েন্স অর্জন না করা পর্যন্ত সাভারের চামড়া শিল্পনগরী বন্ধ রাখার সুপারিশ বাস্তবায়ন না করায় কমিটি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা বন্ধ করার জন্য কমিটি আবারও সুপারিশ করেছে।
‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিক বন্ধ
আগামী ১ মার্চ থেকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগের কার্যালয়ে প্লাস্টিকের কাপ, কাঁটা চামচ, প্লেট- ইত্যাদি একবার ব্যবহারের প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা হবে না বলে সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয় বৈঠকে।
এ বিষয়ে সভাপতি বলেন, “কোনো ধরনের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক তারা ব্যবহার করবে না। এগুলো যেহেতু নিজস্ব অফিস, এখান থেকেই শুরু হোক সেটা চাই। আমরা চাইব পরে এটা বড় পরিসরে চালু হবে। যেমন, আমাদের লক্ষ্য আছে এটা সংসদ ভবনেও বাস্তবায়ন করার। এজন্য আমরা স্পিকারকে অনুরোধ করব।”
বায়ুমান বিষয়ক হেলথ অ্যালার্ট
কখন কোথায় বায়ুর মান কেমন, দূষণের মাত্রা কতটা, সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত হেলথ অ্যালার্ট জারির ব্যবস্থা করতে বলেছে সংসদীয় কিমিটি।
এ বিষয়ে সভাপতি বলেন, “আমাদের যে প্রযুক্তি আছে তাতে আজকের বায়ুমানের পরিসংখ্যান আগামীকাল জানাতে পারি। এটা কোনো কাজে আসে না। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মনিটরিং করা এবং মানুষকে যেন বিষয়টি তাৎক্ষণিক জানাতে পারি। যার জন্য আমরা এটাকে দুই-তিন মাসের মধ্যে লাইভ করতে বলেছি। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছি।”
তিনি বলেন, “এটা সম্ভব হলে আমরা হেলথ অ্যালার্ট দিতে পারব। এতে করে মানুষ বাসা থেকে বের হবে কি না- বা কোন এলাকায় তারা যাওয়া থেকে বিরত থাকবে- সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই হেলথ অ্যালার্ট দেওয়া নেতিবাচক কিছু নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এটা হয়। এটা হলে মানুষ তার মুভমেন্টের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”
সাবের হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ বৈঠকে কমিটির সদস্য পরিবেশনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, জাফর আলম, খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন এবং মো. শাহীন চাকলাদার অংশ নেন।