আল আমিন বেরোবি প্রতিনিধি
গণিত কেবল সত্যই প্রকাশ করে না, তার মধ্যে রয়েছে অনন্ত সৌন্দর্য। আর এই সৌন্দর্যকে সবার মাঝে তুলে ধরেতে এবং গনিতের ভীতি দুর করতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) শিক্ষার্থী ওবায়দুর কনক নিজ উদ্যোগে প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে গনিত শিক্ষা দিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন , আমি এই কাজ বিগত ৫ মাস ধরে করে আসছি ।আর আমি মনে করি নিজের ভাই বোনকে পড়লে যেমন কেউ মূল্য নেয় না,ঠিক তেমনি ভাবে আমি সবাইকে গনিত পড়াই ভাতৃত্বের টানে টাকার জন্যে না । আর সেই জন্য আমি কারো কাছে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করি না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি’র) ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের সপ্নবাজ শিক্ষার্থী গনিত প্রেমী ওবায়দুর কনক । তিনি বিগত ৫ মাস ধরে বর্তমান অবধি বেরোবি ক্যাম্পাসে প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে প্রতি বরি, মঙ্গল ও বৃহস্পিবার গনিত পাঠদান করে আসছেন। যা বেরোবি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মোত্তালেব হোসেন বলেন, ”আমি ওবায়দুর কনক ভাইয়ের গনিত ক্লাস নিয়মিত করি ৷ তার ক্লাসের মাধ্যমে আমি অনেক উপকৃত হচ্ছি ৷ তার শেখানোর ধরন অনেক সহজ এবং প্রানবন্ত ৷ আমি মনে করি ভাইয়ের গনিত ক্লাস যদি কেউ নিয়মিত করে,তার গনিতের ভীতি অনেকটাই দূর হবে ইনশাআল্লাহ ৷ আমি ভাইয়ের উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করি ৷”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া পারভীন বলেন, “আমি ওবায়দুর কনক ভাইয়ার গনিত ক্লাসের একজন নিয়মিত ছাত্রী। নিয়মিত হওয়ার পেছনে একটি গল্প আছে। শুরু থেকেই গনিত আমার একটি ভালোলাগা এবং আগ্রহের জায়গা। তাই আমি চেয়েছিলাম একজন দক্ষ ব্যক্তির সান্নিধ্যে গণিতের চর্চা করতে । সেই উদ্দেশ্যেই আমি ভাইয়ার প্রথম ক্লাস করতে যাই, এবং এখন নিয়মিত প্রতিটি ক্লাস মনযোগ সহকারে করি । তার শেখানোর পদ্ধতি অত্যন্ত চমৎকার, যা আমার গণিতের বড় বড় সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সমাধান করতে সাহায্য করছে। তার এই মহতী উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। ওবায়দুর কনক ভাইয়ার সর্বাঙ্গীণ সফলতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।”
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো: আনিসুর রহমান বলেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে ওবায়দুর কনক ভাইয়ের মহৎ উদ্যোগ এর কথা জানতে পারি। গণিত এর প্রতি ভয় অনেক আগে থেকেই কাজ করতো। যার ফলে ভালোভাবে গণিত শেখার সাহস করা হয়নি কখনোই । কিন্তু এখন তো জব প্রিপারেশন এর জন্য করতেই হবে। তাই কোনো কিছু না ভেবেই গেলাম ভাইয়ার ক্লাসে। আমি ভাইয়ার গনিত ক্লাস নিয়মিত করি ৷ তার ক্লাসের মাধ্যমে আমার গণিতের প্রতি ভীতি দূর হচ্ছে, নতুন নতুন অনেক জানা অজানা বিষয় জানতে ও বুঝতে পাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ্ ৷ তার শেখানোর ধরন অনেক সহজ এবং সাবলীল৷ আমি মনে করি, যদি কেউ ভাইয়ার প্রতিটি গনিত ক্লাস নিয়মিত করে, তার গনিতের প্রতি ভীতি দূর হবে ইনশাআল্লাহ৷ ওবায়দুর কনক ভাইয়ের এমন নিঃস্বার্থ উদ্যোগ বর্তমান সময়ে বিরল। যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ভালো কিছু করার উৎসাহ যোগাবে।”
তরুণ প্রজন্মের এই স্বপ্নবাজ বলেন “আমার উদ্যেশ্য হচ্ছে- আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই-বোনদের গণিত শিখতে উৎসাহিত করা । যাতে গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই গণিতে তাদের মোটামুটি ধারণা তৈরি হয় । এছাড়া তাদের কাছে গণিতকে সহজভাবে উপস্থাপন করে। তাদের ভেতরের গণিত ভীতিটা আছে সেটা দূর করা । এই প্লাটফর্মটা আমি তৈরি করে দিয়ে গেলাম , কিন্তু এটা ধরে রাখার দায়িত্ব বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের উপর ন্যস্ত থাকবে । হয়তো আমার জব হলে আমি চলে যাব কিন্তু আমার জায়গায় অন্য আর একজন স্বেচ্ছাসেবী এসে গণিত শেখার এ ধারা অব্যাহত রাখবে। এভাবেই এটা একদিন ক্যারিয়ারভিত্তিক বড় সেবামূলক প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠবে যার সুফল ভোগ করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীরা । একটা সময় দেখা যাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে জব সেক্টরে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করবে। মূলত এটিই আমার উদ্যেশ্য , আমি প্রায় ৫ মাস ধরে এটা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আমার সাধ্যানুযায়ী সেবা দেয়ার চেষ্ঠা করছি। বর্তমানে আমার প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে ।”
গণিত ভীতিকে মনোরোগবিদরা বলছেন, এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক সমস্যা। এই সমস্যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তি গণিতে যে ভালো করতে পারেন, এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।এছাড়া ভয়ের কারণগুলোকে ভেঙে সমাধানের সূক্ষ্ম উপায় বের করার কথাও বলছেন মনোরোগবিদরা।
জেনে নেই গণিতভীতি দূর করার উপায়:
প্রথমে শিক্ষার্থীকে গণিতের প্রতি আগ্রহী করতে হবে, গণিতের প্রতি তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। গণিত মুখস্থ করার কোনো বিষয় নয়। তবে সূত্র মুখস্থ করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই গণিত বুঝতে হবে, বুঝে নিয়ে গণিত চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধুমাত্র পাঠ্যবই কেন্দ্রিক না করে ধাঁধা, কুইজ, সুডোকু, পুলসাইড পাজল, দাবা, বোর্ড গেম, রুবিক’স কিউব বা গণিতের নানা ধরনের অনলাইন খেলার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। এসব খেলা মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তোলে।গণিত নিয়ে অনেক মজার মজার বই রয়েছে, অনলাইন প্রবন্ধ রয়েছে, সেগুলো পড়া যেতে পারে।বিভিন্ন ছবি, ইলাস্ট্রেশন, ভিডিও, এনিমেশনের মাধ্যমে অংক শেখাটা অনেকটাই সহজ হতে পারে।
বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিল রেখে যদি গণিত শেখানো হয়। সেটা বেশি মনে থাকে।শুরুতে গণিতের জন্য সময় বেধে না দিয়ে, নিজের মতো লম্বা সময় ধরে শিখতে উৎসাহিত করুন। প্রথমে সময় বেশি লাগলেও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।সবচেয়ে ভালো হয়, অল্প কয়েকটা সহজ অংক দিয়ে শুরু করা। এতে আগ্রহ বাড়বে। অনেকে অংক করার আগেই উত্তরপত্র দেখে নেন। এটা অনেকটা নিজেকে ঠকানোর মতো কাজ। উত্তর না দেখে আগে যাচাই করুন। ভুল থেকেই শেখা হবে। নামতার হিসেব কিভাবে হল, সূত্রগুলো কিভাবে এল, এগুলো যাচাই করলে, মনে রাখা সহজ হবে।সবসময় ক্যালকুলেটর বা গুগল নির্ভর না হয়ে, ছোটখাটো হিসাব মাথায় সেরে নেয়ার চেষ্টা করুন।তবে অংকের ভীতি দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল নিয়মিত অনুশীলন। প্রতিদিন অল্প হলেও অংক করার অভ্যাস করলে আস্তে আস্তে এতে পারদর্শী হওয়া সম্ভব।
গণিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হলেন, একজন ভালো শিক্ষক। এছাড়া যাদের গণিতে আগ্রহ রয়েছে। তারা অন্যদের ভীতি দূর করতে এগিয়ে আসতে পারেন।নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে গণিত বিভাগে অধ্যয়নরত আইনার স্কালভিক বলেছেন, গণিতের ভীতি কাটাতে সব শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মন খুলে কথা বলা বা প্রশ্ন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
গবেষণায় দেখা যায় যে গণিত ভীতিতে থাকা শিক্ষার্থীরা অন্যদের সামনে ছোট হওয়ার ভয়ে থাকেন এবং কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না।ভুল করাটা শেখার প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তাই লজ্জা, আর ভয় কে জয় করে আপনাদের গনিত শিখতে হবে।